গাজায় খাদ্য, ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইসরায়েল। আর এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এ অবরোধের দরুন সৃষ্ট খাদ্যসংকট বহু ফিলিস্তিনির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রতিবাদস্বরূপ সম্প্রতি অনশন শুরু করেছেন গাজা সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল। গত ২০ জুলাই, রোববার তিনি তার অনশন ঘোষণা করেন। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের অন্যায় কর্মকাণ্ড এবং গাজার দুর্দশা নথিবদ্ধ করে আসছিলেন তিনি, যার জন্য তাকে অনবরত ইসরায়েলি দমনপীড়নের শিকার হতে হয়।
বাসাল তার ঘোষণায় বলেন, ‘আমি মাহমুদ বাসাল, একজন ফিলিস্তিনি নাগরিক ও একজন স্বাধীন মানুষ। অনেক দিন ধরেই গাজা উপত্যকার বিশ লাখেরও অধিকসংখ্যক মানুষের মতো আমিও নগণ্য পরিমাণ খাবার খেয়ে বেঁচে আছি। আজ খাদ্যের চরম সংকটের কারণে আমি পূর্ণ অনশনের ঘোষণা দিচ্ছি। চলমান মানবিক সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। যে বিশ লাখেরও বেশি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে নীরবতা পালন করছে গোটা বিশ্ব, সেই অসহায় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি আমি।’
গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য সংকটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। যে পরিমাণ খাদ্য এখন পর্যন্ত গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে, তাতে এ অঞ্চলের জনগণ কোনোমতে অপুষ্টিকর অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারছে বলে জানা গেছে। তবে চলতি মাসে আমরা এ খাদ্যসংকটের চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাচ্ছি। দশকের পর দশক ধরে এরকম অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞাকে স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তৃতায় ধাপে ধাপে যে বিকৃত প্রচারণা চালানো হয়েছে, তা ফিলিস্তিনিদের অমানবিকভাবে চিত্রিত করেছে। এর ফলে গাজায় বারবার আগ্রাসন চালাতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েল।
আমাদের বিভীষিকাময় এক বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিয়েছে এ আগ্রাসন, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। ইসরায়েলি বাহিনী বর্তমানে ক্ষুধার্ত ও নিরস্ত্র মানুষদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। শুধু খাবারের সন্ধানে ঘর থেকে যারা বের হয়েছেন, তাদের স্নাইপার, ড্রোন ও কামান ব্যবহার করে হত্যা করা হচ্ছে। নিজেদের ভূমিতেই অনধিকারে প্রবেশকারী হিসেবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে এ মানুষদের, অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তাদের।
মাহমুদ বাসাল যেদিন তার অনশন ঘোষণা দেন, সেদিনই পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী কবি ও লেখক মোসাব আবু তোহা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আজকের দিনটি ছিল সহ্যের অতীত। আমার ভাই তার প্রাণ হারিয়েছে, আমার স্ত্রীর ভাই ও অন্য আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই হতাহত হয়েছেন। আমার পাড়ার বহু পরিচিত লোক, যারা খাবারের সন্ধান করতে গিয়েছিল, তারা বাড়ি ফিরেছে কাটাছেঁড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে। তাদের কেউ ছিল তরুণ, কেউ ছিল বৃদ্ধ, কেউ ছিল কারও পিতা, কেউ ছিল কারও পুত্র। নিজের পরিবারকে একমুঠো খাবার এনে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল তারা।’ বেইত লাহিয়ায় নিজের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথমে মিশর এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন এ লেখক।
এদিকে সিরিয়া ও লেবাননে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে ইসরায়েল সরকার। ফিলিস্তিনে তাদের ভূমি দখলের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশ্ববাসীর নজর কৌশলে অন্যদিকে ধাবিত করছে তারা। নতুন গঠিত সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রে বন্দুকের গুলিতে আহতদের একই ধরনের চোটের কথা তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ সার্জন নিক মেনার্ড। তিনি বলেন, ‘আহতদের শরীরের যে অংশে গুলি লাগছে, তার একটা সুস্পষ্ট প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে। কোনো দিন দেখা যাচ্ছে সবার পেটে গুলি করা হয়েছে; আরেক দিন হয়তো গুলি করা হয়েছে মাথা বা গলা লক্ষ্য করে। আবার অন্য একদিন দেখা যাচ্ছে, সবার হাত বা পায়ে গুলি করা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন শরীরের কোন অঙ্গ বরাবর গুলি চালানো হবে, সে ব্যাপারে বাজি ধরে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী! এটা তাদের জন্য একটা খেলায় পরিণত হয়েছে।’
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে খবরের শিরোনামগুলো যেন ইচ্ছাকৃতভাবে ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখছে। সাজানো রাজনীতি, নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোয় ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে নাটকীয় কংগ্রেস শুনানির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের এ চলমান সংকট থেকে আমেরিকান নাগরিকদের মনোযোগ সরিয়ে রাখা হচ্ছে। এ সাজানো মামলাগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব প্রশাসককে ডাকা হচ্ছে, তারা নিজেরাই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করেছে। অস্ত্র উদ্ভাবনের গবেষণা ও দমনমূলক প্রযুক্তিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকায়, সেই গবেষণাগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে ফিলিস্তিনপন্থি কণ্ঠস্বর রয়েছে, সেটাকে দমন করার পূর্ণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনকি যেসব প্রশাসক আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, তাদেরও বিভিন্ন দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। ইসরায়েলি বা মার্কিন নীতির সমালোচনা করলেই হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। যে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইসরায়েলপন্থি পররাষ্ট্র নীতিকে সমর্থন করছে না, তাদেরও পৃথকভাবে খেসারত দিতে হচ্ছে।
নিউইয়র্ক রাজ্যের সিটি ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর ফেলিক্স মাতোস রড্রিগেজ সম্প্রতি কংগ্রেস সদস্য এলিস স্টেফানিকের কঠোর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন যে, আন্দোলন সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। শুনানির আগেই রড্রিগেজ বাধ্য হয়ে চারজন খণ্ডকালীন অধ্যাপককে বরখাস্ত করেছিলেন। তারা ফিলিস্তিনপন্থি মতপ্রকাশ করেছিলেন বিধায় এ পরিণতি হয় তাদের। এরপরও রড্রিগেজকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করলে সে তার নিজ দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সৌদি আরব ২০১৬ সালে ইয়েমেনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তার কারণে ইয়েমেনেও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে সেটার ওপর তেমন কোনো গুরুত্বারোপ করা হয়নি। সেই ব্যাপারে মার্কিন নাগরিকদেরও বিশেষ উদ্বেগ নেই। ফলে ইয়েমেনের সশস্ত্র হুতি আন্দোলন আনসারুল্লাহ যখন গাজা ও ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে, তখন সেটাকে ‘অযৌক্তিক’ বলে চালিয়ে দিতে সমর্থ হয় মার্কিন সরকার। তারা দাবি করে যে, অতীতের গণহত্যার সঙ্গে বর্তমান প্রতিরোধের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিশ্ব বর্তমানে বহুমেরুকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন বাণিজ্যপথে নতুন মিত্রতা গড়ে উঠছে। তিন দশক ধরে একক ক্ষমতা চর্চাকারী যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাই প্রবল আতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। তাদের সাম্প্রতিককালের কর্মকাণ্ডগুলো অধোগামী এক সাম্রাজ্যের দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
২০২০ সালে হঠাৎ করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগপর্যন্ত, গোটা বিশ্বজুড়ে বইছিল এক বিশাল প্রতিবাদের ঢেউ। যেমন গাজার ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’, আলজেরিয়ার হিরাক আন্দোলন, ইরাক, লেবানন, চিলি, কাতালোনিয়া, হংকং প্রভৃতি জায়গার গণআন্দোলন ইত্যাদি। গোটা পৃথিবী যেন আগুনে জ্বলছিল। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিগণ ও জোটগুলো বুঝে গিয়েছিল যে, এ আন্দোলনগুলো পরস্পর আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। যদিও আন্দোলনগুলোর অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীরা সেটা বুঝতে পারেনি।
৯/১১-পরবর্তী সময়ের মতোই, করোনা মহামারির নামে কায়েম করা নীতিমালা সমাজের মৌলিক কাঠামোগুলোকে পাল্টে দিয়েছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে শুরু করে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যাওয়া, সবই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে সম্পদের বিপুল স্থানান্তর কিন্তু অবৈধ হয়ে যায়নি। অতি কৌশলে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ তৈরি করে ফেলা হয়। স্পর্শ, ঘনিষ্ঠতা, সামাজিক অনুষ্ঠান—সবই হয়ে ওঠে আতঙ্কের বিষয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি, বাকস্বাধীনতা ও অবাধ চলাচলের নীতির চরম বিকৃতি, সমাজকে আমূল পাল্টে দেয়।
স্বাধীনতা, অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাণিজ্যপথ প্রাত্যহিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক অদ্ভুত ঘুরপথে আমরা যেন আবার সেই পুরোনো অতীতে ফিরে এসেছি। স্নায়ুযুদ্ধের সেই আন্তর্জাতিক নীতিগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। কৃত্রিম শত্রু তৈরি করা এবং তার ওপর ভিত্তি করে ভয়ের রাজনীতি চর্চা করার মাধ্যমে পশ্চিমা গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী রূপ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পূর্বসূরি, ‘অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস’-এ কর্মরত নৃবিজ্ঞানী গ্রেগরি বেটসন বলেছিলেন, ‘প্রভুদের জন্য দর্শকসুলভ মানসিকতা এবং ভৃত্যদের জন্য প্রদর্শনীসুলভ মানসিকতা উৎসাহিত করা প্রয়োজন।’ ঐতিহাসিকভাবে আত্মরক্ষার সব উপায় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে ফিলিস্তিনের জনগণকে। তাদের আর্তনাদ যেন প্রদর্শনী আর যারা এ সংকট তৈরি করেছে, তারা দর্শক। ক্ষুধা থেকে রেহাই পেতে একমুঠো খাবারের সন্ধানে প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে গাজার অধিবাসীদের। তাদের এ চরম মানবিক সংকট আজ সমগ্র মানবসভ্যতার জন্য এক সতর্কবার্তা।
জোরপূর্বক এ অনাহার ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের কোনো নৈতিক বা আইনি ভিত্তি নেই। আজও এটা অবৈধ, ভবিষ্যতেও অবৈধ থাকবে। এ বর্বরতা বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। সর্বোচ্চ পর্যায়ের মিথ্যা দাবিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। গাজার খাদ্যসংকটের প্রতিবাদ করতে সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে এক তরুণ মিশরীয় অভিবাসী মিশরীয় দূতাবাসের ফটকে শিকল লাগিয়ে, মেঝেতে ময়দা ছিটিয়ে, ডিম ছুড়ে প্রতিবাদ জানান। তার এ ছোট্ট অথচ সাহসী উদ্যোগটা যেন পশ্চিমা বিশ্বের প্রতারণার পর্দাটা ছিঁড়ে ফেলে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আমরা যে উপসংহার টানতে পারি, সেটা হলো- ক্ষমতাসীনদের নিরঙ্কুশ দমননীতিকে প্রকাশ্যে মহিমান্বিত করা হচ্ছে। জোরপূর্বক মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায়বিচার, আন্তর্জাতিক আইন এবং পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে। এ করুণ দৈত্যাকার শক্তিকে যে কোনো মূল্যেই হোক পরাজিত করতে হবে। প্রতিটি বিসর্জন, প্রতিটি কষ্টের ঘটনা, প্রতিটি অপরাধ মনে রাখতে হবে যেন—এ গণহত্যার নেপথ্যের সবাইকে একদিন জবাবদিহির মুখোমুখি করা যায়।
লেখক: মার্কিন অধ্যাপক, সাহিত্যিক ও সমালোচক। নিবন্ধটি মিডল ইস্ট আইয়ের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
নিউজটি আপডেট করেছেন : জার্নাল ডেস্ক