এই ‘মাচা
ম্যানিয়া’র পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
ইনফ্লুয়েন্সারদের মাচা তৈরির কৌশল, স্বাদ পর্যালোচনা ও রেসিপি শেয়ারিংয়ে
ব্যস্ত থাকার ফলে ‘মাচা টক’ হ্যাশট্যাগে ইতিমধ্যে কোটি কোটি ভিউ জমা হয়েছে।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে জাপানে পর্যটন বেড়েছে, সেই সঙ্গে বিশ্ববাসীর আগ্রহও
জাপানি সংস্কৃতি, খাবার ও চায়ের দিকে ঝুঁকেছে। স্থানীয় পণ্য কেনার আগ্রহে
ম্যাচার জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। এ ছাড়া জাপানের মুদ্রার দাম কমার কারণে
দেশটির পণ্য কিনতে আগ্রহ বেড়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এই দুইয়ের মিশেলেই
বেড়েছে মাচার জনপ্রিয়তা।
মাচা
(Matcha) হলো একধরনের জাপানি গ্রিন টি বা সবুজ চা, যা বিশেষভাবে চাষ,
প্রক্রিয়াজাত এবং গুঁড়া করা হয়। এটি মূলত তেনচা (Tencha) নামের চা-পাতার
গুঁড়ো, যাকে কয়েকটি বিশেষ ধাপ অনুসরণ করে তৈরি করা হয়। মাচা চা কেবল পানীয়
হিসেবেই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি বিভিন্ন রেসিপি—যেমন আইসক্রিম, কেক,
লাটে বা ডোনাটেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
মাচা চায়ের
প্রস্তুতপ্রণালি সাধারণ গ্রিন টির চেয়ে ভিন্ন এবং পুষ্টিগুণেও এগিয়ে।
সাধারণ গ্রিন টি তৈরি হয় পাতার নির্যাস দিয়ে—চা-পাতাগুলো গরম পানিতে ভিজিয়ে
রেখে যে তরল পাওয়া যায়, সেটিই পান করা হয়। এ ক্ষেত্রে চা-পাতাগুলো পরে
ফেলে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, মাচা চা তৈরিতে
সম্পূর্ণ চা-পাতা গুঁড়া করে সরাসরি পানিতে মিশিয়ে পান করা হয়। ফলে পাতার
প্রতিটি অংশ শরীরে প্রবেশ করে, যার ফলে এতে থাকে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট,
ভিটামিন ও মিনারেল। এ কারণেই মাচাকে গ্রিন টি’র তুলনায় অধিক পুষ্টিকর ও
স্বাস্থ্যসম্মত মনে করা হয়।
‘এক কেজি মাচা চাই প্রতিদিন’
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টি ইম্পোর্টার লরেন পারভিস বিবিসিকে জানিয়েছেন, তাঁর
গ্রাহকেরা যে পরিমাণ মাচা এক মাসে ব্যবহার করতেন, তা এখন কয়েক দিনেই শেষ
হয়ে যাচ্ছে।
মিজুবা টি কোম্পানির মালিক পারভিস বলেন, ‘কিছু ক্যাফে প্রতিদিন এক কেজি মাচা চাইছে। তারা হাহাকার করছে।’
এই
তীব্র চাহিদার সঙ্গে মিলছে না মাচার সরবরাহ। কারণ জাপানে রেকর্ড ভাঙা
দাবদাহে কমেছে চা উৎপাদন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র জাপানের পণ্যের ওপর যে শুল্ক
আরোপ করেছে, সেটাও দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।
মাচা
প্রস্তুত হয় তেনচা নামের গ্রিন টি পাতার গুঁড়া দিয়ে। এগুলো চাষের সময় কয়েক
সপ্তাহ ছায়ায় রাখা হয়, যাতে এর বিশেষ ‘উমামি’ অর্থাৎ, কোমল কাঁচা স্বাদ
তৈরি হয়। পরে পাতা শুকিয়ে পাথরের চাকি দিয়ে ধীরে ধীরে গুঁড়া করা হয়। এভাবে
প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৪০ গ্রাম মাচা উৎপাদন করা যায়।
তবে
সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহের কারণে বিশেষ করে কিয়োতোর তেনচা উৎপাদন
মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দেশটির ২৫ শতাংশ তেনচা আসে এই অঞ্চল থেকে।
চাষিরাও সংকটে পড়েছেন। জাপানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে তরুণদের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে।
কিয়োতোর
উজি শহরে পর্যটকের ভিড়ে দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গেই মাচা শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তাই অনেক দোকান এক ব্যক্তিকে এক টিন মাচার বেশি বিক্রি করছে না।
ক্যামেলিয়া
টি সেরিমনির পরিচালক আতসুকো মোরি জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় তাঁদের
ক্রেতার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে টিনপ্রতি সীমা বেঁধে দিতে হয়েছে।
চা
মাস্টার রিয়ে তাকেদা জানাচ্ছেন, আগে যে অর্ডার কয়েক দিনে পৌঁছাত, এখন তা
পেতে সপ্তাহ লেগে যাচ্ছে। রিয়ে তাকেদা টোকিওভিত্তিক চা অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান
চাজেনে কাজ করেন, যেখানে অতিথিদের জন্য ঐতিহ্যবাহী রীতিতে মাচা পরিবেশন
করা হয়।
চাহিদা ও সংকটের কারণে এ বছর চাজেনের শাখাগুলোতে মাচার দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
তাকেদা বলেন, চাহিদা ভালো। এটি জাপানি সংস্কৃতি জানার এক প্রবেশদ্বার।’
উৎপাদন বাড়লেও সংকট কাটেনি
জাপানের
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মাচা উৎপাদন
প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ২০২৪ সালে দেশটির সবুজ চা রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬
দশমিক ৪ বিলিয়ন ইয়েনে, যার মধ্যে একটি বড় অংশই মাচা।
মাচা নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে উত্তেজনা চলছে, তার মধ্যে অনেকেই ‘মাইন্ডফুল কনজাম্পশন’ বা সচেতনভাবে ব্যবহারের আহ্বান জানাচ্ছেন।
অতিরিক্ত
মজুত বা অতিরিক্ত দামে বিক্রির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ
বলছেন, উচ্চমানের মাচা রান্নায় ব্যবহার না করে মূল স্বাদ উপভোগ করাই শ্রেয়।
মোরি বলেন, সেরা মানের চা রান্নায় ব্যবহার হওয়া দুঃখজনক, কারণ এতে এর সূক্ষ্ম স্বাদ হারিয়ে যায়।’
গ্লোবাল
জাপানিজ টি অ্যাসোসিয়েশন সবাইকে রান্নার জন্য অপেক্ষাকৃত কম মানের মাচা
ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে, যেগুলো অধিক হারে উৎপাদিত হয় এবং স্বাদেও বেশি
টেকসই রান্নায়।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আর চাপ বাড়াবে
সম্প্রতি
ওয়াশিংটন ও টোকিওর একটি বাণিজ্য চুক্তির ফলে জাপানি পণ্যে ১৫ শতাংশ আমদানি
কর আরোপিত হয়েছে। ফলে মাচার দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন
ব্যবসায়ীরা।
ওরেগনভিত্তিক উদ্যোক্তা পারভিস জানিয়েছেন, জুলাই মাসের শুরুর দিকে চুক্তির সময়সীমার আগে তাঁদের অর্ডার ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়।
তিনি
বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে মাচা উৎপাদিত হয় না। তাই এ খাতে স্থানীয় শিল্প
সুরক্ষার জন্য শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতা নেই। আমরা আশা করি বিশেষায়িত চা
খাতকে ছাড় দেওয়া হবে।
যদিও দাম ও সংকট
বাড়ছে, তবু আশার আলো দেখছেন কেউ কেউ। ‘দ্য মাচা টোকিও’র সহপ্রতিষ্ঠাতা
মাসাহিরো নাগাতা বিবিসিকে বলেছেন, নিম্নমানের মাচার উচ্চ দামে বিক্রি
দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এখন একটা ট্রেন্ড চলছে, চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, তবে আমরা
মনে করি আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে।