ঢাকা | বঙ্গাব্দ

ব্যবস্থাপত্র জটিলতায় ওষ্ঠাগত রোগীর প্রাণ

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Mar 11, 2025 ইং
ব্যবস্থাপত্র জটিলতায় ওষ্ঠাগত রোগীর প্রাণ ছবির ক্যাপশন: ব্যবস্থাপত্র জটিলতায় ওষ্ঠাগত রোগীর প্রাণ
ad728

চিকিৎসক এক রোগীর ব্যবস্থাপত্রে হার্ট ফেইলিওরের গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ‘স্যাবিকার্ড’ লিখেছেন। কিন্তু ওষুধের দোকানি চিকিৎসকের হাতের লেখা বুঝতে না পেরে তীব্র কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘সোডিকার্ব’ ধরিয়ে দেন। রোগীর ছেলে দোকানির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, চিকিৎসক লিখেছেন ৫০ এমজি আর আপনি দিয়েছেন ৬০০ এমজি। দোকানি নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেন ডাক্তার ভুল করে ৬০০ এমজির স্থলে ৫০ এমজি লিখেছেন। এই ওষুধ ৬০০ এমজি ছাড়া হয় না। তবে এই যাত্রায় রোগী বেঁচে যান। কারণ সংশয় থেকে ওষুধের সঠিকতা যাচাই করতে রোগীর ছেলে ওষুধ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে হাজির হন। পরে চিকিৎসক নিজ দায়িত্বে ভুল শুধরে দেন।

এভাবে চিকিৎসকের উদাসীনতা এবং ওষুধের দোকানির অজ্ঞতা, অসততা ও অপরাধপ্রবণতায় অনেক রোগীর প্রাণ এক ধরনের ওষ্ঠাগত। খোদ রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকায় এই চিত্র স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শুধু চিকিৎসকের অস্পষ্ট লেখা এবং ওষুধের দোকানিদের নিজ দায়িত্বে ওষুধ দেওয়ার প্রবণতায় অগণিত রোগী সুস্থতার মুখ দেখেন না। অনেকে ভুল ওষুধ সেবনের কারণে অসুস্থ থেকে তীব্র অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি এসব ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটাও অস্বাভাবিক নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত ওষুধের দোকানদারদের অতি মুনাফা প্রবণতা ও নিজেদের বিজ্ঞ মনে করা, দ্বিতীয়ত ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক বিপণন এবং তৃতীয়ত এক শ্রেণির চিকিৎসকের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীণতা। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে প্রতিপালন করলে এ ধরনের সমস্যা সমাধান সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউর ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো দোকান ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। তবে ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগের আওতামুক্ত থাকবে। এ ছাড়া ডাক্তার যে ওষুধ লিখবেন, দোকানিকে সেটাই দিতে হবে, অন্য নামের অন্য কোম্পানিরটা নয়। নিজের লাভ বা ওষুধ কোম্পানির প্রচারণার ফাঁদে পড়ে দোকানি যেন অন্য কোনো ওষুধ রোগীকে নিতে প্ররোচিত না করেন। এতে শুধু রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই রোগীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সঠিক ওষুধ বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে।

এ ধরনের জটিলতা নিরসনে ২০১৭ সালে ৯ জানুয়ারি চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র পড়ার উপযোগী ও স্পষ্ট এবং বড় অক্ষরে লেখার নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এমনকি পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিএমডিসির নিবন্ধককে সার্কুলার জারি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনকি পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিপ্ততরের মহাপরিচালক, বিএমডিসির নিবন্ধককে এই সার্কুলার জারির বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। আইনজীবী মনজিল মোরসেদের জনস্বার্থে করা এই রিট আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এ ছাড়া ব্যবস্থাপত্র পড়ার যোগ্য অক্ষর অথবা বড় হাতের অক্ষর অথবা ছাপা অক্ষর এই তিনটির যে কোনো একটি পদ্ধতিতে দেওয়া হয় সে বিষয়ে কেন সরকারকে নির্দেশনা দেওয়া হবে না এবং ওষুধের নাম জেনেরিক টার্মে (প্রকৃত নাম) কেন লেখা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়।

তবে উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনার পর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সামান্যই। রাজধানীর বেসরকারি পর্যায়ের কিছু করপোরেট হাসপাতালে কম্পিউটার টাইপ করা ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়। বাকি সব চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান রোগীর চাপে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বেমালুম ভুলে বসে আছেন। ফলে এ ধরনের ঘটনা নৈমিত্তিকে পরিণত হয়েছে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা ৩১ মিনিটে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মারুফ রায়হান খান তার ফেসবুক লেখেন, রোগীকে কিনতে বলা হয়েছে এনকর-২.৫ এমজি, দোকানি রোগীকে দিয়ে দিয়েছে ফিনকর-১০ এমজি।

এ প্রসঙ্গে ডা. মারুফ রায়হান খান বলেন, এক বাচ্চার এক দিনের ডায়রিয়া। এক ওষুধের দোকানি ৫টি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন। নিজের সামান্য লাভের জন্য শিশুটার ক্ষতি করতে এদের একটুও হাত কাঁপে না। ওষুধের দোকানিদের নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। কিছু ওষুধের দোকানি সন্ত্রাসের চেয়েও বড় অপরাধ করে। এদের প্রতিহত না করা গেলে জনগণ নীরবে ধুঁকতেই হবে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ওষুধের দোকানিদের একটা প্রবণতা রয়েছে, তার দোকানে যে ওষুধ রয়েছে যে কোনোভাবে রোগীকে সেটাই গছিয়ে দেওয়া। দেশের বেশিরভাগ ওষুধের দোকান নিয়মানুযায়ী নিবন্ধিত নয়। আবার নিবন্ধিত দোকানগুলোও যথাযথ নিয়মে ফার্মাসিস্ট দ্বারা পরিচালিত নয়। তাই জেনেরিক লিখলে খুব কম সংখ্যক দোকানদার সেই ব্যবস্থাপত্র বুঝে ওষুধ দিতে পারবেন। তা ছাড়া কিছু ওষুধ কোম্পানির অতি মুনাফার প্রবণতা তো আছেই। সব মিলিয়ে এ সমস্যা সমাধান কঠিন, তবে জরুরি। সরকার পর্যায়ক্রমে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।


নিউজটি আপডেট করেছেন : জার্নাল ডেস্ক

কমেন্ট বক্স