নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না হলেও আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহাকে ‘নির্বাচন প্রস্তুতি’ হিসেবে কাজে লাগাতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। একইসাথে দলের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী এবং জেলা ও মহানগরসহ বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদেরকে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতেও বলা হয়েছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দল হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা যাতে বৃদ্ধি পায়, সেজন্য সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডেও জড়িত থাকতে বলা হয়েছে নেতাকর্মীদের।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী সরকারের অব্যাহত হামলা-মামলা, দমন-পীড়নের কারণে বিগত ১৫-১৬ বছর তারা নির্বিঘ্নে এলাকায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারেননি।

কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর এবারই প্রথম ঈদুল আজহা উদযাপন করবে দলটি। গত রোজার ঈদের মতো এবার মুক্তপরিবেশে শঙ্কাহীন ও স্বস্তিতে ঈদুল আজহাও উদযাপন করবেন নেতারা।

এবার ঈদুল আজহায় দীর্ঘ সরকারি ছুটি রয়েছে। বৃহস্পতিবার (০৫ জুন) থেকে প্রায় অর্ধমাস ঈদ আমেজে কাটবে সারাদেশ। এর মধ্যে সরকারি ছুটিই আছে দশদিন। নেতারা ইতোমধ্যে নিজ এলাকায় যাওয়া শুরু করেছেন। আজ-কালের মধ্যে প্রায় সবাই নিজ নির্বাচনী এলাকায় চলে যাবেন। কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

জানা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের কোরবানি দেয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতেও কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তৃণমূল নেতারা সেটা পালন করবেন। বিশেষ করে যারা বিএনপির সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী, তারা এই সময়টাতে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবেন।

প্রতিটি আসনে বিএনপির কমপক্ষে ৩/৪ জন প্রার্থী রয়েছে। তারা সবাই ঈদের এই সময়টাতে যেমন নিজ নিজ কর্মদক্ষতা ও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি এবং তৃণমূলে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করবেন; একইসঙ্গে কেন্দ্রেরও মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করবেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা ঈদের সময় কী কী কর্মকাণ্ড করছেন, সেগুলো তারা কেন্দ্রে পাঠাবেন, কেউ কেউ সেটা পাঠাবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছেও।

বিএনপি জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে আগামীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়, জনগণের কাছে সে বার্তা পৌঁছে দিতেও নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে যে শাসন ব্যবস্থা ছিল, আগামীতে সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না, এ ধরনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে জনগণকে কাছে টানতেও বলা হয়েছে।

বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরে তাদের নির্বাচনী মেনুফেস্টুর আকারে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। সেটি এখনো চলমান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে যেগুলো জনঘনিষ্ঠ, নেতারা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও ঈদপুনর্মিলনীর মধ্য দিয়ে তা পুনরায় সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরবেন।

দেশবাসীকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এবারের ঈদে বিএনপির বার্তা হলো- নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ উদযাপন করবেন। বিশেষ করে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের কথাবার্তা এবং আচরণে মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণের পাশে থাকতে হবে।

বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে সোচ্চার থাকলেও ঈদের এই সময়টাতে ইস্যুটি তুলনামূলকভাবে শিথিল রাখবে দলটি। অর্থাৎ রোডম্যাপ ইস্যু ঘিরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আপাতত থাকবে না। এই সময়ে তারা ঈদকেই ফোকাস করবেন।

নেতারা তৃণমূলে গিয়ে নানা মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কাছে টানার ওপর জোর দিবেন। উচ্চ আদালতের আদেশের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথের ব্যবস্থা করার দাবিতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনও নিরবচ্ছিন্ন যে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন, ঈদকে সামনে রেখে সেই কর্মসূচিতেও বিরতি দিয়েছেন তিনি।

সরকার আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি তখন শক্ত অবস্থান নিতে পারে বলে দলটির বিভিন্ন পর্যায় থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তখন মিত্র দলগুলোর সাথে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে দলটি।

বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা এবার নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করবেন। আর যারা ঢাকায় ঈদ করবেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ঈদের নামাজ শেষে যাবেন এলাকায়। অনেক নেতা ইতোমধ্যে কৌশলে এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবারকে ঈদ উপহারও পৌঁছে দিচ্ছেন নেতারা। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগেও ঈদ উপলক্ষ্যে উপহারসামগ্রী বিতরণ করছেন।

মুক্ত পরিবেশে ঈদ করবেন খালেদা জিয়া : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘ সাত বছর পর মুক্ত পরিবেশে এবার ঢাকায় গুলশানের ভাড়াবাসা ফিরোজায় আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করবেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দেশে মুক্ত পরিবেশে কোন ঈদ উদযাপন করতে পারেননি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে প্রথম রোজার ঈদ করেন তিনি।

সম্প্রতি চিকিৎসা শেষে দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামীলা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেন। ইতোমধ্যে সৈয়দা শামীলা রহমান দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানের কাছে যুক্তরাজ্যে ফিরে গেছেন।

বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে ডা. জুবাইদা রহমানের। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছেন স্বামী তারেক রহমান এবং তাদের একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার জায়মা রহমান। তারা এবার যুক্তরাজ্যে ঈদ করবেন। ঈদের দিন রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সিনিয়র নেতারা সাক্ষাৎ করবেন। এছাড়া ঈদের দিন সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফাতেহা পাঠ ও দোয়া করবেন দলের সিনিয়র নেতারা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ঢাকায় ঈদ করবেন। এসব নেতারা পরে নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাবেন।

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস নিজ এলাকা ঢাকার শাহজাহানপুর, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নিজ নির্বাচনী এলাকা কেরানীগঞ্জে স্থানীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নিজ এলাকা নরসিংদীর পলাশে, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামে, সালাহউদ্দিন আহমেদ কক্সবাজারে এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জে ঈদ করবেন। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকায় ঈদ করবেন।