চার দিনের সফর শেষে গতকাল রোববার বাংলাদেশ ছেড়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এর আগে ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশে এলেও তার এবারের সফরটি ছিল অনেকটাই কৌশলগত। তবে তার এ সফর অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, জাতিসংঘ মহাসচিব আমাদের সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করায় দলগুলোও অনেকটা আস্থা পাবে। সর্বোপরি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে জাতিসংঘ সহায়তার যে আশ্বাস দিয়েছে, এটি আমাদের জনগণকেও আশাবাদী করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বিশ্বজুড়ে ইউএসএআইডি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও মহান ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও বেরিয়ে গেছে তারা। এরই মধ্যে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। মিয়ানমার থেকে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা বন্ধ না করলেও কমে গেছে অর্থের পরিমাণ। আগে জনপ্রতি সাড়ে ১২ ডলার খাদ্যের জন্য প্রদান করা হলেও এখন (এপ্রিল) অর্ধেকের বেশি কমে তাদের দেওয়া হবে ৬ ডলার। রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা খাতেও প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নির্বাচন নিয়ে চ্যালেঞ্জ ও সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতাও থামছে না। এমন বেসামাল পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করছে।
বাংলাদেশ সফরে দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন গুতেরেস। কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গাশিবির পরিদর্শন করেন। ঢাকায় এসে তিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, তরুণ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান, রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন এবং তাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে লড়াই বন্ধ করা ও সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের সব প্রতিবেশী দেশের চাপ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে আমাদের মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে, যাতে প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।’ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে অনেকটাই সমাধানের পথ হিসেবে আন্তর্জাতিক সংলাপকে গুরুত্ব দেন জাতিসংঘের মহাসচিব। এ ছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে একটি চ্যানেল তৈরির আলোচনা হচ্ছে, যার মাধ্যমে আরাকানে সহায়তা পাঠানো সম্ভব হবে।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আরাকানে সহায়তা দিতে বাংলাদেশ করিডোর দিলেও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে আগে। জাতিসংঘের এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে। এ ছাড়া আরাকানদেরও মতামত প্রয়োজন হবে এই কাজে। পাশাপাশি সব প্রতিবেশী দেশেরও সম্মতি লাগবে। আরাকানের সঙ্গে সম্পর্ক করা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে, যেহেতু জান্তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রয়েছে। তবে আরাকানদের সাহায্য করলেই যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে, এমন ভাবা যাবে না।
এ নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমাদের আন্তর্জাতিক সংলাপের গুরুত্ব মেনে নিয়ে সংলাপ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চাইলে চীনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রাখতে হবে। এ মাসে প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু চীন যাবেন, তখন তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সাহায্য চাইতে হবে। আমি মনে করি, প্রধান উপদেষ্টা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উত্থাপন করবেন এবং সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন। তবে রোহিঙ্গারা নিরাপদ পরিবেশের আস্থা না পেলে ফেরত যেতে চাইবে না। যেহেতু আরাকানদের সাহায্য করতে বাংলাদেশের করিডোর দেওয়ার কথা উঠছে, তাই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির সুযোগ হবে এবং নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার পথ তৈরি হবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মানবিক করিডোর খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, মানবিক করিডোর দিতে চাইলে সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোরও সম্মতি লাগবে। এ ছাড়া আরাকানে সহায়তা দিলেই যে আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করা যাবে, এমনটা ভাবা যায় না। জাতিসংঘের মহাসচিবের এবারের আগমন গুরুত্ব বহন করলেও আদৌ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে কি না, সেটা দেখতে হবে। এর আগেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন; কিন্তু সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারিনি। এখনো যে এই সংকট দূর হয়ে যাবে এমনটি নয়।
রোহিঙ্গা ছাড়াও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও যে এবার জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আগ্রহ দেখানো হয়েছে, তা দৃশ্যমান ছিল। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে যৌথ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সংস্কার ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ পর্বে রয়েছে। বাংলাদেশের এই সন্ধিক্ষণে শান্তি, সংলাপ ও ঐকমত্যে সহায়তার জন্য জাতিসংঘ তৈরি আছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, টেকসই গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চাওয়া গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার। এ ছাড়া সংস্কার কমিশনগুলোর সঙ্গে গুতেরেসের বৈঠকে তারা সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘সংস্কার প্রয়োজনীয়। জাতিসংঘ এতে পাশে থাকবে। সংস্কার কীভাবে, কতটুকু হবে, তা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হয়ে করতে হবে।’ পর্তুগালের উদাহরণ দিয়ে তিনি আশাবাদ জানিয়েছেন, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো মিলে এই পথ পাড়ি দিতে পারবে।
এর আগে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এতটা ভাবতে দেখা যায়নি জাতিসংঘকে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সাহায্যে ও পাশে থেকে কাজ করার আশ্বাস বাড়তে থাকে।
এ নিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের সময় কী হয়েছে, তা আমরা কিন্তু সেভাবে জানি না। তবে আমি মনে করি, বর্তমানে অভ্যন্তরীণ যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তা তিনি সমাধান করতে পারবেন না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদেরই ঠিক করতে হবে। আমাদের দেশের জনগণই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তার কথায় প্রতীকী গুরুত্ব থাকলেও আন্তর্জাতিকভাবে এটা সমাধান সম্ভব নয়। এর আগেও চেষ্টা করে তেমন লাভ হয়নি। আর এবার জাতিসংঘের মহাসচিব যা বলেছেন, তা আমাদের জনগণেরও কথা। আমরা আগে থেকেই ঐকমত্যের কথা বলছি।
আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের জন্য নির্বাচন নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে, সেখানে জাতিসংঘের বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো ইতিবাচক জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে যে নতুন একটি পরিবর্তন এসেছে, সেখানে জাতিসংঘ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মহাসচিব আমাদের সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করায় দলগুলোও অনেকটা আস্থা পাবে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে তারা আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে, এটি আমাদের জনগণকেও আশাবাদী করেছে।