সরকারের নানা তৎপরতায় পাঠ্যবই ছাপায় প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট ভেঙে যাওয়ায় মাধ্যমিকের বই ছাপাতে এবার সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে ৪৫০ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গত ১৯ আগস্ট সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির ৩২তম সভায় মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির জন্য মোট ৪ কোটি ৩২ লাখ বই ছাপানোর জন্য ৬০৩ কোটির টাকার একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেয়নি সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটি। ৩০০ লটের এসব বইয়ের (৮ পৃষ্ঠায় এক ফর্মা) গড় ফর্মাপ্রতি দর ছিল ৩ টাকা ১৯ পয়সা।
অভিযোগ রয়েছে, সব প্রেস মালিক একজোট হয়ে সমঝোতার মাধ্যমে সেই দরপত্র দেয়। দরপত্র দেওয়ার আগে কয়েক দফা বৈঠক করে কোন প্রেস কত লটের কাজ পাবে এবং কত দর দেওয়া হবে, নির্ধারণ করা হয়। কয়েকজন প্রেস মালিক সমঝোতার বিপরীতে নিজেদের মতো করে দরপত্র দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের ২০২৩ সালের মতো পরিণতি (ওই বছর একচেটিয়া দরপত্র হয়) ভোগের হুমকি-ধমকি দিয়ে নির্ধারণ করে দেওয়া দর দিতে বাধ্য করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, এ সমঝোতায় নেতৃত্বে দেয় শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই আনন্দ প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী রব্বানী জব্বারসহ মুদ্রণ শিল্প সমিতির শীর্ষ কয়েকজন নেতা। এ নিয়ে গত ১৩ আগস্ট ‘বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণ, সমঝোতার দরপত্রে গচ্চা ৩২৩ কোটি টাকা’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করে কালবেলা। এরপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে কাজ শুরু করে এবং তিন শ্রেণির দরপত্র অনুমোদন আটকে দেওয়া হয়।
আগের দরপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বড় প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে দরপত্রগুলো প্রতিযোগিতামূলকের বদলে একচেটিয়া হয়। যদিও প্রেস মালিকদের দাবি, চলতি বছর নতুন নতুন কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়ায় খরচ বাড়বে, এজন্য বাড়তি দরে দরপত্র দিতে হয়েছে। তবে সরকার সেই দরপত্র অনুমোদন না করে পুনঃদরপত্র দেয়। এরপর সরকারের নানা মহলের তৎপরতা প্রেস মালিকরা আগের মতো সমঝোতার দরপত্র দিতে পারেননি। ফলে স্বাধীনভাবে প্রেস মালিকরা দর দেওয়ায় আগের চেয়ে প্রতি ফর্মায় গড়ে ১ টাকা কম পড়েছে। এতে শুধু মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপাতে সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে ৪৫০ কোটি। তবে মাধ্যমিকে সমঝোতার দরপত্র ঠেকিয়ে অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হলেও প্রাথমিকের বই ছাপানো হচ্ছে সমঝোতায় দেওয়া বাড়তি দরে দরপত্রেই। সেখানে সমঝোতার দরপত্র ঠেকানো গেলে সরকারের আরও অন্তত ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনসিটিবির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গতকাল রোববার মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির বই ছাপাতে পুনঃদরপত্র উন্মুক্ত হয়েছে। এই শ্রেণির বইয়ের জন্য ১০০টি লটে ভাগ করে দরপত্র দেওয়া হয়। নতুন দরপত্রে আগের চেয়ে প্রতি ফর্মায় গড়ে খরচ প্রায় ১ টাকা কমিয়ে ধরা হয়েছে ২ টাকা ২০ পয়সা। দেড় মাস আগে একই ধরনের স্পেসিফিশনের বইয়ের জন্য প্রেস মালিকরা সমঝোতা করে যে দরপত্র দিয়েছিলেন, তাদের ফর্মাপ্রতি দর ছিল ৩ টাকা ১৮ পয়সা। সর্বশেষ সমঝোতার দরপত্র দেওয়ায় গতকাল রোববার একইভাবে নবম শ্রেণিতে বই কেনাকাটার একটি প্রস্তাব ক্রয় কমিটি ওঠার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ওঠেনি বলে জানা গেছে।
এনসিটিবি জানিয়েছে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩০ কোটির বেশি পাঠ্যবই ছাপাবে সরকার। এজন্য মোট ৮২৬টি লটে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করছে এনসিটিবি। এরমধ্যে প্রাথমিকের মোট ১৩০ কোটি ৬ লাখ ৬৯ হাজার এবং মাধ্যমিকের ৪৪৫ কোটি ৭১ লাখ ১৬ হাজার ফর্মা ধরা হয়েছে। প্রাথমিকের কাজ শুরু হলেও মাধ্যমিকের বই ছাপানো এখনো শুরু করা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত কয়েক বছর বিনামূল্যের বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবই ছাপার কাজটি নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও নওফেলের আস্থাভাজন প্রেস মালিকরা। এমনকি গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও একজন সাবেক মন্ত্রীর ভাইয়ের নেতৃত্বে ওই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য উল্টো আরও শক্তিশালী হয়। দরপত্র প্রক্রিয়ায় কারসাজির মাধ্যমে সিন্ডিকেটটি এ বছর সরকারের পাঠ্যবই ছাপানোর খরচ গত বছরের চেয়ে ৩২৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর রিয়াদ চৌধুরী কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এনসিটিবির অন্য একজন সদস্য কালবেলাকে বলেন, আগে সিন্ডিকেটের কারণে ইচ্ছা থাকলেও প্রতিযোগিতা দর দিতে পারত না প্রেস মালিকরা। এখন যেহেতু সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করেছে, তাই প্রেস মালিকগুলো স্বাধীনভাবে দর দিতে পারায় বাজারের প্রকৃত চিত্র এসেছে।
একজন প্রেস মালিক কালবেলাকে বলেন, আগে আমাদের ইচ্ছা থাকলেও এখন যে দর দিয়েছি, তা দিতে পারতাম না। যেহেতু সরকার আমাদের অভয় দিয়েছে, তাই বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দর দিয়েছি। এতে সরকারের সাশ্রয়ের পাশাপাশি এখানে দীর্ঘদিন ধরে চলা সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কালবেলাকে বলেন, সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার হস্তক্ষেপের ফলে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে দরপত্র দিয়েছে। অনেক প্রেসে অভিজ্ঞতার সনদ শিথিল করায় প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এতে সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে।